সম্প্রতি ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ার সংবাদ প্রকাশিত হলে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। রাজধানীতে মাদকসেবী ঐশীর হাতে পুলিশ কর্মকর্তা বাবা ও মা খুনের পর আবার আলোচিত হচ্ছে মাদক ও মাদক ব্যবসার কথা। উল্লেখ্য ঐশীকে মাদক সরবরাহ করতো স্থানীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আরিফ এবং ছাত্রশিবিরের ক্যাডারদের একটি গ্রুপ।
রাজধানী ঢাকা সহ দেশের প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যায় ফেনসিডিল। দাম বেশি হওয়ায় ছাত্রশিবির বেছে নিয়েছিল ফেনাড্রিল নামক কাশির সিরাপের সাথে নেশা জাতীয় ঔষধ মিশিয়ে সস্তায় ফেনসিডিলের ব্যবসা। ফেনসিডেল পাশাপাশি এখন ভয়াল রূপ নিয়েছে মরণ নেশা ইয়াবা। ছাত্রশিবিরের মত সংগঠন মাদক ব্যবসায় জড়িত হওয়ায় তার ব্যাপ্তি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশংকা রয়েছে। জানা যায় বিভিন্ন কর্মসূচীর সময় মিছিলের মাঝে তারা মাদকের বড় বড় চালান পার করে।
অনেক মাদকসেবী মাদকের টাকা যোগাতে শিবিরের কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিবির নেতা জানায়, জামাতের মৌন সমর্থনে মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসার সাথে শিবিরকে জড়ানো হচ্ছে। এর ফলে মাদকাসক্তদের নিয়ে সফল কর্মসূচী পালন সম্ভব হয়। অন্যদিকে মাদকসেবীরা টাকার কারণে সভা সমাবেশে যোগ দেয়া ছাড়াও সক্রিয়ভাবে শিবিরের সাথে যুক্ত থাকে।
বিভিন্ন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র থেকে জানা যায় বর্তমান সময়ে মাদকাসক্ত মানেই ইয়াবাসেবী। মাদকাসক্তদের অধিকাংশই ইংরেরি মাধ্যম ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
সহজলভ্যতাই মাদক হিসেবে ইয়াবা গ্রহণের প্রধান কারণ। তাছাড়া এটি যৌন উত্তেজক। যদিও পরবর্তীতে এ কারণে যৌনক্ষমতা হারাতে হয়। তাছাড়া বাবা-মায়ের গাইড না থাকা এবং খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে মিশেই মূলত ছেলে-মেয়েরা ইয়াবা গ্রহণ করে।
অধ্যাপক মো. গোলাম সামদানী ফকির বলেন, ‘মাদাকাসক্ত হওয়ার পেছনে তিনটি বিষয় কাজ করে। এগুলো হলো-বাব-মার সন্তানের প্রতি খেয়াল না রাখা, ছেলে-মেয়েদের হাতে অতিরিক্ত টাকা দেয়া এবং খারাপ বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মেশা। বর্তমানে বাব-মারা নিজেরাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাদের সন্তান কী করে, কোথায় যায় তা খোঁজ রাখে না। বন্ধু নির্বাচনে যেসব বাবা-মা খেয়াল করেন না তাদের সন্তানরাই বেশি মাদকাসক্ত হয়।’
যুবক-যুবতিরা বর্তমানে যেসব মাদক দ্রব্য গ্রহণ করছে সেগুলো হলো-ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফাইড স্প্রিট, কেডিন, ফেনসিডিল, তাড়ি, প্যাথেডিন, ব্রুপ্রেনরফিন, টিডি জেসিক, ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড, ওয়াশ (জাওয়া), বনোজেসিক ইনজেকশন (বুপ্রেনরফিন), টেরাহাইড্রোবানাবিল, মরফিন, আইসপিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, মিথাইল, ইথানল ও কিটোন। এছাড়া ইনোকটিন, সিডাকসিনসহ বিভিন্ন ঘুমের ট্যাবলেট, জামবাকসহ ব্যথানাশক ওষুধ কিংবা টিকটিকির লেজ পুড়িয়ে কেউ কেউ নেশা করে থাকে।
মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৯১ ভাগই কিশোর ও তরুণ। শতকরা ৪৫ ভাগ বেকার এবং ৬৫ ভাগ আন্ডার গ্র্যাজুয়েট। ১৫ ভাগ উচ্চ শিক্ষিত মাদকাসক্তও রয়েছেন।
নগরীতে প্রতিদিন তিন লক্ষাধিক পিস ইয়াবা বিক্রি হয়। চার রকমের ইয়াবা বিক্রি পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে গাঢ় লাল রঙের ‘চম্পা’ প্রতি পিস খুচরা ২০০ থেকে ২৩০ টাকায় বিক্রি হয়। টেকনাফে এটি কেনা হয় ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়। হালকা গোলাপী রঙের ‘আর সেভেন’ ইয়াবার দাম সবচেয়ে বেশি। এটি ঢাকায় কমপক্ষে ৫০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। হালকা গোলাপী রঙের আরেক ধরনের ইয়াবার নাম ‘জেপি’। এর খুচরা মূল্য ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। ‘ডগ’ নামের মাটি রঙের ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। এছাড়া, বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে দেশেই তৈরি হচ্ছে আরেক ধরনের ভেজাল ইয়াবা। এগুলো ১৫০ থেকে ১৭০ টাকায় পাওয়া যায়।
ইয়াবা আকারে ছোট হওয়ায় সহজে বহন করা যায়। সেবনকারী ও বিক্রেতারা খুব সহজে নিরাপদে সেবন ও বিক্রয় করতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কাও কম বলে খুব সহজেই বিক্রি করা যায় যেখানে-সেখানে বসেই। যারা ইয়াবা সেবন করে তারাই বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত। রাজধানীজুড়ে গড়ে উঠেছে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অপ্রতিরোধ্য নেটওয়ার্ক। এর মধ্যে ‘ডিরেক্ট পার্টি’ নামে পরিচিত পাইকারি বিক্রেতার সংখ্যাই তিন শতাধিক। দেশে এক লাখেরও বেশি মানুষ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মাদক ব্যবসায় প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী এবং শিশু-কিশোররাও সম্পৃক্ত।
রাজধানীতে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এমন ১১৬ জন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর তালিকা করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে। রাজধানীতে পাইকারি ও খুচরা মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক মাদক স্পট নিয়ন্ত্রণ করছে এসব ব্যবসায়ীরা।
মাদকাসক্ত হলে তাদের চিকিৎসা করানো উচিৎ। চিকিৎসার মাধ্যমে তারা সহজেই ভালো হয়ে যায়।