সর্বশেষ সংবাদ

6/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

হেফাজতের অপতৎপরতা বন্ধের দাবি পোশাক শ্রমিকদের

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের পোশাক শ্রমিক মহাসমাবেশে হেফাজতে ইসলামকে একটি জঙ্গি সংগঠন বলেও আখ্যায়িত করে হেফাজতের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
মহাসমাবেশে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা নির্ধারণের দাবি জানিয়ে শ্রমিক নেতারা বলেছেন, আন্দোলন করেই এ দাবি আদায় করা হবে। এ দাবিতে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরে এ ধরনের মহাসমাবেশ করা হবে। শ্রমিক মহাসমাবেশকে ন্যূনতম মুজরির দাবি আদায়ের আন্দোলনের নমুনা বলেও জানান শ্রমিক নেতারা। ন্যূনতম মজুরি নিয়ে কোনো প্রকার ছল-চাতুরি বরদাশত করা হবে না বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তারা।

লাখো শ্রমিক-জনতার এ মহাসমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী ও বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের আহবায়ক মো. শাজাহান খান প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে অনুরোধ জানান, মালিকদের কাছ থেকে শ্রমিকদের বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম মজুরি আদায় করে দিতে। তিনি বলেন, আমাদের শ্রমিক ভাই-বোনেরা নানা অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেন। মানবেতর জীবনযাপন করেন। আশা করবো, আপনি তাদের সব সমস্যার সমাধান করবেন। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে যেভাবে ন্যূনতম মজুরি তিন হাজার টাকা নির্ধারিত হয়েছিল একইভাবে শ্রমিকদের দাবি অনুযারী খেয়ে-পরে বাঁচার মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য ন্যূনতম মজুরির ব্যবস্থা করার দাবি জানান তিনি।

মন্ত্রী বলেন, মালিকদের বলতে চাই, শ্রমিকরা আপনাদের প্রতিপক্ষ নয়। সবাই একই পরিবারের সদস্য। নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠি ভাঙচুর করে পরিস্থিতি নষ্ট করতে চাচ্ছে মাত্র। আল্লামা শফী নারীদের নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা প্রত্যাখ্যানেরও অনুরোধ জানান নৌ-মন্ত্রী। শনিবার দুপুর পৌনে তিনটায় জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে এ মহাসমাবেশ শুরু হয়ে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চলে।
শ্রমিক নেতাদের মধ্যে মহাসমাবেশে বক্তব্য রাখেন ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব শায়খুল হাদিস মাওলানা মনিরুজ্জামান রাব্বানী, শ্রমিক নেত্রী শিরিন আক্তার, পোশাক শ্রমিক নেতা জেড কামরুল আলম, আবুল হোসাইন, মাহবুবুর রহমান ইসমাইল, লাভলী ইয়াসমীন, শামীমা নাসরিন, তপন সাহা, বাবুল আকতার, পরিবহন শ্রমিক নেতা ওসমান আলী, সাধারণ শ্রমিক মামুনসহ অন্যান্যরা।
সকাল থেকে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার গার্মেন্টস শ্রমিক সমাবেশে জড়ো হন মহাসমাবেশে। এ সময় তাদের হাতে নানা রকম দাবি সম্বলিত ব্যানার ও ফেস্টুন দেখা যায়। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের ব্যানারে লাখো পোশাক শ্রমিক যোগ দেন সমাবেশে। ঢাকার বাইরে থেকেও আসেন শ্রমিকরা।

জিএসপি সুবিধা পুর্নবহাল, গার্মেন্টস কারখানা ভাঙচুর বন্ধ, বাঁচার মতো ন্যূনতম মজুরি, নারী শ্রমিকদের গৃহবন্দি করার ষড়যন্ত্র বন্ধের দাবিতে এ গার্মেন্টস শ্রমিক মহাসমাবেশের আহ্বান করে গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ। সমাবেশে শ্রমিক সংগঠনগুলো থেকে আনা ব্যানারেও আল্লামা শফির কঠোরতম শাস্তি দাবি করা হয়। নারীদের তেঁতুল বলে অপমানকারী হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শফীকে আশ্রয়দাতা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ারও রেহাই নাই বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন শ্রমিক নেত্রী শিরিন আক্তার।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে অর্থনীতিতে যে নারীরা ভূমিকা রাখছেন তাদের তেঁতুল হুজুর বলেন, মেয়েদের দেখলে নাকি পুরুষের লালা ঝরে। আমি তা মানি না। কারণ, সেই পুরুষ আমার ভাই, বাবা, সহকর্মী। আমাকে দেখলে আমার বাবা, ভাই বা সহকর্মীর লালা ঝরতে পারে না।

নারীনেত্রী শিরিন আক্তার আরও বলেন, শ্রমিকরা উন্নয়নের চাবিকাঠি। ভোর পাঁচটা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তারা পরিশ্রম করে পরিবার ও দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখেন। তাদের মধ্যে নারী শ্রমিকদের অবদানই বেশি। অথচ তাদের উদ্দেশ্য করে শফী বলেন তেঁতুলের মতো লালা ঝরে’! তাই নারীদের যিনি তেঁতুল বলেছেন, তার যেমন রেহাই নাই, তেমনি তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা খালেদা জিয়ারও রেহাই নাই। জনগন তাদের মাফ করবে না। খালেদা জিয়াকেও জবাবদিহি করতে হবে। শিরিন বলেন, কোনো মহিলাকে দেখেই কোনো পুরুষের লালা ঝরে না। কারণ, সেই পুরুষ কোনো না কোনো নারীর পিতা ভাই অথবা সন্তান। যারা ধর্মের নামে ফতোয়া দেন, নারী নির্যাতন করেন, ওই সব শফী হুজুররা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন?

মহাসমাবেশের ঘোষণাপত্র পাঠকালে বদরুদ্দোজা নিজাম বলেন, আল্লামা শফী তার তেঁতুল তত্ত্ব দিয়ে বক্তব্যের মাধ্যমে শুধু নারী জাতিকেই নয়, পুরুষ জাতিকেও অপমান করেছেন। এই মহাসমাবেশে হেফাজতকে তাই জঙ্গি সংগঠন বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। হেফাজতের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি।

মজুরি বোর্ডে মালিকদের পেশকৃত প্রস্তাব এই সমাবেশে শ্রমিকরা প্রত্যাখান করলেন। শ্রমিকদের বাঁচার মতো মজুরি নির্ধারণের দাবি জানাচ্ছি। নয়তো আমরা কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো। ঘোষণাপত্র পাঠকালে রানা প্লাজা ধস ও তাজরীন অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্থদের ‘লস অব আর্নিংস’ এর আওতায় ক্ষতিপূরণের দাবি জানানো হয়। ঘোষণাপত্রে বলা হয়, শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যেসব মিথ্যা মামলা করা হয়েছে, তা অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। বাড়িভাড়া আইন কার্যকর করতে হবে। পোশাক শিল্পের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র বন্ধসহ জিএসপি পুনঃর্বহাল করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান জানাচ্ছি। কথিত ইসলামী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শফী নারীদের বিরুদ্ধে কথা বলে কুরআন-হাদীসের অবমাননা করেছেন বলে মহাসমাবেশে মন্তব্য করেন ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব শায়খুল হাদিস মাওলানা মনিরুজ্জামান রাব্বানী। তিনি বলেন, শফী নারীদের ঘরে বন্দি রাখা ও তাদের অধিকার নষ্ট করার জন্য নারীদের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি নারীদের কটাক্ষ করেছেন। এমনকি নারী শিক্ষা নিয়ে শফী যে বক্তব্য রেখেছেন তা যদি প্রত্যাহার না করা হয়, তাহলে নারীরা আন্দোলনের মাধ্যমে তার উচিত জবাব দেবেন বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। শফীর বক্তব্য প্রত্যাহার করার আহবানও জানান মনিরুজ্জামান রাব্বানী। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বর্তমান সরকারকে দেশে-বিদেশে বিতর্কিত করতে একটি গোষ্ঠি কৌশলে হেফাজতকে ব্যবহার করছে।

গার্মেন্টস খাতকে অস্থিতিশীল করতে হেফাজতকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের বক্তব্য প্রদানে একটি গোষ্ঠি ইন্ধন প্রদান করছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

সংহতি প্রকাশ করে পরিবহন শ্রমিক নেতারা মহাসমাবেশে বলেন, আমরা সবাই শ্রমিকদের দাবি আদায়ে প্রত্যয়ী। এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম রয়েছেন পরিবহন শ্রমিক নেতারাও। আন্দোলনের সময় আপনারা পরিবহন ভাংচুর করবেন না। প্রয়োজনে পরিবহন বন্ধ রেখে আমরা আপনাদের সঙ্গে আন্দোলনে শরিক হবো। তাছাড়া শ্রমিকরা সবাই ভাই ভাই। এক ভাইয়ের অধিকার আদায়ে সব শ্রমিক ভাইয়েরা একসঙ্গে কাজ করবেন। শ্রমিক নেতা ও নৌমন্ত্রী মো. শাজাহান খান গার্মেন্টস মালিকদের আশ্বস্ত করে বলেন, আমরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে যাচ্ছি। আমরা গার্মেন্টসে কোনো ভাংচুর করবো না। তিনি বলেন, যে গার্মেন্টেসে কাজ করে শ্রমিকদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়, সে গামেন্টেসে শ্রমিকরা ভাংচুর করতে পারেন না। যে শ্রমিকরা কারখানা থেকে আয় করেন সে শ্রমিকরা কারখানায় আগুন দিতে পারেন না। একটি মহল আন্দোলনকে অন্যদিকে প্রবাহিত করতে পরিকল্পিতভাবে কারখানা ভাংচুর ও অপপ্রচার চালাচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। এ অপপ্রচারকে প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানিয়ে শাজাহান খান বলেন, ওই সমস্ত ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করুন।

আল্লামা শফীকে উদ্দেশ্য করে মন্ত্রী বলেন, আপনি ওয়াজ-নছিহত করেন। আবার নারীদের উদ্দেশ্য করে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। আপনার বিবেক কি বলে? আপনারও তো মা-বোন আছে। মহাসমাবেশে সবাই আপনার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি প্রসঙ্গে তিনি মালিকদের বলেন, ন্যূনতম মজুরি আট হাজার একশ’ টাকা দাবি করা হয়েছে। আর আপনারা বাড়াতে চাচ্ছেন মাত্র ছয়শ’ টাকা। আপনাদেরও তো সন্তান আছে। তাদেরও খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করেন। শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য ন্যূনতম খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করেন। শ্রমিকদের ন্যূনতম বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করেন।

তিনি তার বক্তৃতায় বর্তমান সরকারের প্রশংসা করে আগামীতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে আহবান জানান। মন্ত্রী বলেন, অনেকে বলবেন, আমি মন্ত্রী হিসেবে সরকারের দালালি করছি। আমি মন্ত্রী হিসেবে নয়, শ্রমিক নেতা হিসেবে শ্রমিকদের দাবি আদায়ে আন্দোলন করছি।

মালিকদের উদ্দেশ্যে মন্ত্রী বলেন, শ্রমিক আর মালিকদের সাথে কোন দ্বন্দ্ব নেই। আপনারা (মালিক) বসেন। প্রয়োজনে দর কষাকষি হবে। তবুও শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি পূরণ করুন। দাবি আদায়ে কোনো শ্রমিক আর ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও করবেন না বলেও অঙ্গীকার করেন এই শ্রমিক নেতা। পাশাপাশি শ্রমিকদের দাবি আদায়ে সহিংসতার পথ পরিহারের আহবান জানান তিনি। মহাসমাবেশে প্রায় ৫০টি গার্মেন্টস, পরিবহন ও অন্যান্য শ্রমিক সংগঠন একাত্মতা প্রকাশ করে। পাশাপাশি সংগঠনের নেতাকর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন।

অন্যান্য বক্তারা বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম মজুরি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, অন্যথায় কঠোর আন্দোলন করে দাবি আদায় করা হবে।
শ্রমিক নেত্রী শিরিন আক্তার বলেন, যারা শ্রম আর ঘাম দিয়ে পোশাক শিল্পের উন্নয়নে কাজ করছেন, তাদের ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা দিতে হবে। অন্যথায় দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। শ্রমিক নেত্রী শামীমা নাসরিন বলেন, আজকের এ শ্রমিকদের মহাসমাবেশ হেফাজতের বিরুদ্ধে, শ্রমিক শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে। হেফাজতিরা কোনো ফতোয়া দিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আত্মমর্যাদার সঙ্গে বাঁচার পথ থেকে সরিয়ে ঘরে আবদ্ধ করতে পারবে না। তিনি বর্তমান সরকারের প্রশংসা করে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা করতে সরকারের প্রতি আহবান জানান। মহাসমাবেশে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন রোকেয়া সুলতানা আনজু। পরিচালনা করেন নাজমা আক্তার ও রহিমা আক্তার সাথী।