ফিরোজ আহমেদ
লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান (বরখাস্ত)। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্ষণ ও হত্যার গুজব ছড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে এসেছিলেন। গণতন্ত্রকে কুফুরি মতবাদ হিসেবে আখ্যা দিয়ে অনলাইনে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে খেলাফত প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানোর অভিযোগও উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি তাকে দেখা গেছে নেত্র নিউজ নামের একটি বিতর্কিত পোর্টালের ভিডিও প্রতিবেদনে। আন্তর্জাতিকভাবে জঙ্গি খেতাবপ্রাপ্ত এবং বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতার উদ্দেশ্যে তৈরি করা এ প্রতিবেদনে হাসিনুর রহমান যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেন তাতে রয়েছে ভুল ও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। জনতার সহানুভূতি কামনা করা হাসিনুর রহমানের অতীত কি তা বিবেচনা করলেই এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়।
হাসিনুর রহমান বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে ১০ম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন। তার পিতা মরহুম হাবিবুর রহমান ছিলেন লাকসাম উপজেলা বিএনপি'র সভাপতি। জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে তিনি কুমিল্লা জজ কোর্টের পিপিও ছিলেন। তার চাচা মরহুম প্রফেসর নূরুর রহমান দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের আনুকূল্যে বিএনপি থেকে তৎকালীন কুমিল্লা-১৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পারিবারিকভাবে বিএনপির সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকায় বিএনপি ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য তাকে একটি বিশেষ বাহিনীতে বদলী করা হয়। বিএনপি কর্তৃক প্রদত্ত সেই এজেন্ডা অদ্যাবধি সে বাস্তবায়ন করে চলেছে।
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বিচারবহির্ভূত হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয় তাতে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত ভূমিকা পালন করে হাসিনুর। চট্টগ্রামে একটি বিশেষ বাহিনীতে কর্মরত থাকাকালে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৪টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা ছিলেন হাসিনুর রহমান।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী জামাল উদ্দীনকে হত্যার জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। সাতকানিয়ার আহমদ উল্লাহ বিএনপি থেকে অন্য দলে যোগ দেয়ায় তাকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয় এবং এই ব্যাপারে এলডিপির অলি আহমেদ সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে হাসিনুর রহমানকে দায়ী করেছিলেন।
২০০৭ পরবর্তীকালে হাসিনুর রহমান নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীরে যোগ দেন। এছাড়া জঙ্গি সংগঠন হুজির পলাতক নায়েবে আমীর মাওলানা ইয়াহিয়া, মাওলানা শেখ ফরিদ ও হুজির কমান্ডার মাওলানা সাব্বির এর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তার।
পাবর্ত্য চট্টগ্রামে অবস্থিত ভিন্ন দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের প্রশিক্ষণ শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভিযানের পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন সংবেদনশীল তথ্য নিয়মিত পাচারেও তার সংশ্লিষ্টতার প্রমান পাওয়া যায়। জঙ্গিদেরকে অস্ত্র সরবরাহ ছাড়াও ভিন্ন দেশের কয়েকটি প্রদেশে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র সরবরাহে তার সংশ্লিষ্টতা ছিল।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বৈরি মনোভাবাপন্ন বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার ২ জন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে উত্তরার মাসকট প্লাজার একটি রেষ্টুরেন্টে জঙ্গি সদস্যদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন তিনি। উক্ত স্থান থেকে অস্ত্র বিক্রির সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন হাসিনুর রহমান। নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড ও বৈরী মনোভাবাপন্ন বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকায় তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয় এবং পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় অভিযুক্ত হয়ে ৪ বছর ৩ মাস সাজা ভোগ করে মুক্তিলাভ করেন হাসিনুর।
জঙ্গী তৎপরতা ও সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে জড়িত থাকার দায়ে হাসিনুর রহমানকে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন সামরিক আদালত। এ সময় তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার সরকারের সময় কাউকেই রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার করা হয়নি। অথচ বিএনপি সরকারের সময় বাহাউদ্দিন নাসিম এবং চৌধুরী মাওলানা মতিউরকে ময়মনসিংহের বোমা হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল; যদিও বোমা হামলা করেছিল হরকাতুল জিহাদ।
মুক্তিলাভের পর আবারও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন হাসিনুর। তিনি অসৎ উদ্দেশ্যে পিস্তল নিয়ে চলাফেরা করতেন। সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় এবং লাইসেন্স নবায়ন না করার কারনে তার ব্যক্তিগত পিস্তলের লাইসেন্সটি বাতিল করা হয়েছিল।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে গুমের গুজব, অপপ্রচার ও উগ্রবাদী মতাদর্শ প্রচারের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি এড়াতে ২০১৮ সালে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে চলে যান তিনি। অথচ পরিবারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে গুমের নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। তিনি ২০২০ সালে স্বেচ্ছায় পরিবারের কাছে ফিরে আসেন। তার স্ত্রীও গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন যে, হাসিনুর রহমানের শরীরে কোনো আঘাত বা নির্যাতনের চিহ্ন ছিল না।
হাসিনুর রহমান রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিলেন না। তার আচার আচরণ, বেশভূষা ও অসংলগ্ন কথাবার্তার কারণে তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে গণ্য করছেন অনেকে। তিনি দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উস্কানিমূলক ও অসংলগ্ন বক্তব্য প্রদান করেছেন। 'আয়নাঘর' নামক একটি ভূয়া ও বানোয়াট তথ্যে ভরপুর রাষ্ট্রবিরোধী ভিডিওতে মিথ্যাচার করে তিনি ভাইরাল হওয়ার অপচেষ্টা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
একজন বিতর্কিত, দেশদ্রোহী এবং সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর মিথ্যাচার সচেতন জনগণ কি কখনো বিশ্বাস করে? এদেরকে বর্জন এবং প্রতিরোধ করা আমার আপনার সবার নৈতিক দায়িত্ব।