বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে দলটিকে জেনারেল জিয়া জন্ম দিয়েছিলেন, সেটি শুরুতে একাধিকবার নাম বদল করে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। দলের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছিল এককথায় অস্বাভাবিক। কোনো দেশে যখনই কোনো সামরিক জান্তা নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চেয়েছে, তখন তাদের একটি কাজ হচ্ছে নিজেই একটি দল তৈরি করা এবং অন্য সব ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া। ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, উগান্ডা, চিলি, ব্রাজিল, এল সালভাদর, মিয়ানমার, ইরাক, আলজেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, গ্রিস, স্পেনসহ আরো অনেক দেশের নাম ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে পাওয়া যাবে। ষাট-সত্তরের দশকে নিয়মিত এসব ঘটনা ঘটত এবং তাতে খোলামেলাভাবে ইন্ধন জোগাত গণতন্ত্রের বড় বরকন্দাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে জিয়ার ক্ষমতা দখল এবং এই দখলকাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কী ভূমিকা ছিল, তা এখন ওপেন সিক্রেট। একটি নির্দিষ্ট সময় পর সেই দেশে রাষ্ট্রীয় অনেক গোপন দলিল জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার একটি আইনই আছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে এটিসহ তাদের আরো কিছু বিষয় আছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
জিয়া যখন দল গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন আওয়ামী লীগসহ অন্য সব ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড ছিল নিষিদ্ধ। জিয়া বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া আর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া একপ্রকার হারাম করে দিয়েছিলেন। তিনি যখন কিছু সামরিক-বেসামরিক আমলা, কিছু পেশাজীবী আর স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে তাঁর জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন, তখনো তিনি দেশের সেনাপ্রধান, যা ছিল সম্পূর্ণ সংবিধানবিরোধী। অবশ্য সংবিধানের প্রতি জিয়ার কোনো সম্মান বা আনুগত্য কখনো ছিল না। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, জিয়া এক সামরিক অভ্যুত্থানে ১৯৮১ সালে নিহত হওয়ার পর যাঁরাই দলটির নেতৃত্বে এসেছেন, তাঁরা সবাই জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। শুরু থেকেই রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির ভিত্তি সব সময় দুর্বল ছিল এবং যেহেতু দলটি ক্ষমতায় থাকতেই অভ্যস্ত, সেহেতু তারা যখনই মনে করেছে তাদের রাজনৈতিক ভিত নড়বড়ে, তখনই তারা নানা রকমের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে তাদের অবস্থান অনৈতিকভাবে ধরে রাখতে সচেষ্ট হয়েছে। এর একটি বড় প্রমাণ ২০০৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা তারা দুই বছর বাড়িয়ে নিয়েছিল, যদিও এই বয়স বাড়ানোর দাবিটি বিচারপতিদের কাছ থেকে অনেক আগেই এসেছিল। তখন কিন্তু বিএনপি তা নিয়ে কোনো গা করেনি। ২০০৬ সালের নির্বাচনের আগে তাদের এই কর্মের পেছনে একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তাদের একসময়ে দলীয় পদধারী এবং জিয়ার সময় ইরাকে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকারী বিচারপতি কে এম হাসান যেন নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন। এর ফলে শুধু বিচারপতি হাসানকেই বিএনপি বিতর্কিত করেনি, তখন পর্যন্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত নির্বাচনের সময় একটি গ্রহণযোগ্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেও বিতর্কিত করেছে, যা এখন দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল ঘোষিত হয়েছে।
আসলে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে দেশের জন্য তেমন কোনো কিছু না করে ক্ষমতায় থাকার মজাটাই যে আলাদা তা বুঝে গিয়েছিল। এটি ছিল তাদের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার পর থেকে দলটি সব সময় গণমানুষের রাজনীতি করেছে, তার একটি বড় প্রমাণ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রমনা রেসকোর্সের সেই পড়ন্ত বিকেলের কালজয়ী জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলতে পেরেছিলেন ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি এই দেশের মানুষের অধিকার চাই’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে সপরিবারে নিজ বাড়িতে একদল সেনা সদস্য হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র জানতেন বঙ্গবন্ধুর উপসেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সবচেয়ে যে ব্যক্তিটি লাভবান হয়েছেন, তিনি হচ্ছেন এই জিয়াউর রহমান।
১৯৭৫ সালের পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে ছিল দীর্ঘ ২১ বছর। ছত্রভঙ্গ দলকে ধরে রাখতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীনের স্ত্রী বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, যিনি তাঁর স্বামীর জীবদ্দশায় কখনো রাজনীতি করেননি। ১৫ আগস্টের ঘাতকদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা তখন প্রবাসে অনেকটা উদ্বাস্তুর মতো দিন কাটাচ্ছেন। এমনকি বিদেশে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনও তাঁদের কোনো সহায়তা করেননি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে থেকেই ইতিবাচক ধারার রাজনীতি করার কৌশলটা জন্ম থেকেই রপ্ত করেছে, যা রপ্ত করার মতো ধৈর্য বা সাহস কোনোটাই বিএনপির নেই। বিএনপি ক্ষমতায় যেতেও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছে, আবার জনগণের রোষে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ক্ষমতায় ফেরার জন্যও ষড়যন্ত্রের ওপর নির্ভর করেছে। বিএনপি সব ষড়যন্ত্রে নিবেদিত সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে এ দেশের কিছু শিক্ষিত নাগরিক গোষ্ঠী, কিছু বিদেশি প্রভু, কিছু বামদলের মদদ আর তাদের সব অনৈতিক কর্মকাণ্ড সত্য-মিথ্যার মিশেল দিয়ে জনগণের সামনে তুলে ধরতে এগিয়ে আসা কয়েকটি প্রিন্ট মিডিয়া। এটি এক-এগারোর আগেও দেখা গেছে এবং এখনো তারা বেশ খোলামেলাভাবে কর্মকাণ্ড শুরু করে দিয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এ মূহূর্তে এক-এগারোর কুশীলবদের অন্তত অর্ধডজন বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি চেষ্টা করছেন বিএনপির দাবি অনুযায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাচ্যুত করে যেকোনোভাবে লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে। জাতির জন্য যে এটা কত বড় দুর্ভাগ্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিএনপি দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় গেছে, কিন্তু দলটির বেশ কয়েকটি আদি পাপ তাদের চিরদিন তাড়া করবে। প্রথমটি ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তা জেনেও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে জিয়া তা গোপন রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ঘাতকদের তিনি দেশ ছাড়তে সহায়তা করেছেন, বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে কূটনৈতিক পর্যায়ে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সংবিধানে নিষিদ্ধ থাকা ধর্মভিত্তিক যেসব রাজনৈতিক দল একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে গণহত্যায় লিপ্ত ছিল, তাদের এ দেশে রাজনীতি করার অনুমোদন দিতে তিনি সংবিধান সংশোধন করেছিলেন। তিনি সেখানেই থেমে থাকেননি। একাত্তরে যে শাহ আজিজ বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যার পক্ষে সাফাই গাইতে জাতিসংঘে গিয়েছিলেন, তাঁকে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আমলে দালাল আইনের অধীনে দেশে প্রায় ১১ হাজার পাকিস্তানি এ দেশীয় দোসরের বিচার হচ্ছিল। জিয়া সেই আইন বাতিল করে সেই বিচারকাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মুক্ত করে দিয়েছিলেন সব দালালকে। পরবর্তীকালে তাঁদের অনেকেই জিয়ার রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতির সঙ্গী হয়েছিলেন। জিয়ার সময় বিমানবাহিনীর প্রধান ছিলেন এম এ জি তাওয়াব। তাঁকে জিয়া জার্মানি থেকে এনে এই পদে পদায়ন করেছিলেন। তাওয়াব ১৯৭৬ সালে রমনা রেসকোর্স ময়দানে একাত্তরের ঘাতকদের নিয়ে সিরাত সম্মেলনের নামে এক রাজনৈতিক জলসার আয়োজন করেন। সেই জলসা থেকে একাত্তরের ঘাতক দল স্লোগান তোলে ‘তাওয়াব ভাই তাওয়াব ভাই চান তারা মার্কা পতাকা চাই’। বলা বাহুল্য, এই সম্মেলন জিয়ার অনুমোদন ছাড়া হওয়া সম্ভব ছিল না।
বিএনপি বা তারেক রহমানের সামনে দেশে রাজতন্ত্র কায়েম করার জন্য বর্তমানে একমাত্র বাধা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই দুই বাধা দূর করতে পারলেই ‘কেল্লা ফতে’ বলে মনে করেন বিএনপি ও তার ভারপ্রাপ্ত চেয়াপারসন তারেক রহমান আর দলের বেশ কিছু নেতা। বর্তমানে বিএনপি সঙ্গে পেয়েছে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কিছু ভুঁইফোড় স্বঘোষিত রাজনৈতিক টোকাই নেতা। শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর তাঁকেসহ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে কম চেষ্টা করেনি বিএনপি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় নজিরবিহীন গ্রেনেড হামলা তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এই অপকর্মের সঙ্গে তারেক রহমান যে সরাসরি জড়িত ছিলেন, তা এখন ওপেন সিক্রেট। এই ঘটনার মাস চারেক আগে চট্টগ্রামে ধরা পড়ে ১০ ট্রাক অত্যাধুনিক অস্ত্র। এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি ভারতের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির একজন সে দেশের একটি বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক পত্রিকায় এবং বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনে লোমহর্ষক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। প্রথমটি দিয়েছেন উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী উলফা নেতা অনুপ চেটিয়া। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, তাঁদের সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বিএনপি সরকারের গোচরে ও সহায়তায় হতো। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করার পর অনুপ চেটিয়াকে গ্রেপ্তার করে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনি বর্তমানে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন।
১০ ট্রাক অস্ত্র আটক বিষয়ে সম্প্রতি ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় মুখ খুলেছেন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা মেজর জেনারেল গগনজিৎ সিং (অব.)। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, এ ঘটনা যখন ঘটে, তখন তিনি উত্তর-পূর্ব ভারতে দায়িত্ব পালনরত ছিলেন আর তাঁর অন্যতম কর্তব্য ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতার ওপর নজর রাখা। তিনি তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে তারেকের হাওয়া ভবন, জামায়াত ও বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কিছু কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া জানতেন বিএনপির আরো কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা, বেগম জিয়ার কাছের কিছু লোক। ভারতের সেনা গোয়েন্দা সংস্থার আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা জগজিৎ সিং। তিনি আরো ভয়াবহ এক সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে এই অস্ত্র চোরাচালানের বিষয়ে আরো জড়িত ছিল পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা। তাদের যৌথ উদ্দেশ্য ছিল অবৈধভাবে আসা এই অস্ত্রের একটি অংশ জামায়াত-শিবিরের মাধ্যমে ২০০৬ সালের নির্বাচনের আগে পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে দিয়ে দেশে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করে বিএনপির ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা। ঘটনাচক্রে এই ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ায় পরিস্থিতি বদলে যায়। ভারতও অনেকটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে বলে তিনি জানান।
বর্তমানে বিএনপি ও তার সহযাত্রীরা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তা এক তামাশায় পরিণত হয়েছে। শহর থেকে জেলায়, সেখান থেকে উপজেলায়, মাঝেমধ্যে বিভাগীয় শহরে, তারপর আবার কোনো দূতাবাসে ধরনা, বিদেশে লবি করার জন্য ভাড়াটে লবিস্ট নিয়োগ করা, তাতে কাজ না হলে নিজেদের নেতাদের দৌড়ঝাঁপ, তারপর আবার প্রেস ক্লাবের সামনে জমায়েত, না হয় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বসে কিছু হুংকার। এই হচ্ছে বর্তমানে বিএনপির সরকার হটানোর আন্দোলনের চিত্র। মাঝেমধ্যে তামাদি হয়ে যাওয়া কিছু একদা রাজনৈতিক ব্যক্তির সকালে ঘুম থেকে উঠে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়া কর্মীদের চাঙ্গা করতে ঘোষণা দেওয়া ‘এই আর একটু, টোকা দিলেই সরকার পড়ে যাবে’। এ তো সেই পুরনো কবিতার ‘আর কটা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি’র মতো হয়ে গেল। বিএনপি ও তাদের মিত্রদের সরকার হটাও আন্দোলন এই মুহূর্তে কিছুটা চোরাবালিতে আটকে গেল বলে মনে হচ্ছে। সামনে রমজান, তারপর বর্ষা, এরপর কোরবানির ঈদ।
বিএনপিতে বেশ কিছু উচ্চশিক্ষিত মানুষ আছেন। আরো আছেন কিছু অভিজ্ঞ শ্রমিক নেতা। ব্যারিস্টার আছেন কয়েক গণ্ডা। তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন বা আছেন। তাঁরা ছাড়াও আছেন বেশ কিছু বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের কাছে যখন জানতে চাওয়া হয় বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে কে হবেন আপনাদের প্রধানমন্ত্রী? তাঁরা প্রায় সবাই এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলেন ‘কেন, আমাদের চেয়ারপারসন তারেক রহমান’। কী এক নিদারুণ পরিস্থিতি। সেদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সিনিয়র সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তিনি নির্দ্বিধায় বলে ফেললেন যত দিন তারেক রহমান বিএনপির নেতৃত্বে আছেন, তত দিন বর্তমান সরকারের তেমন কোনো চিন্তা নেই। তাঁর মন্তব্য উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
তবে আওয়ামী লীগের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা নিজ দলের ভেতর অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে রক্তক্ষরণ। ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে কিছু দুর্বৃত্ত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তা আওয়ামী লীগের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। দুই বছর করোনা মহামারির কারণে সারা বিশ্বে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিলাতে কারো কাছে তিনটির বেশি টমেটো বিক্রি হচ্ছে না। বাংলাদেশেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। তবে তার জন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা কতটুকু দায়ী, তা জানতে বড় গবেষক হওয়ার দরকার নেই। তাদের লাগাম টেনে ধরার এখনই সময়।
লেখক : আবদুল মান্নান – বিশ্লেষক ও গবেষক।