নঈম নিজাম
ভেবেছিলাম বাসন্তীকে নিয়ে আর লিখব না। বঙ্গবন্ধুর সময়ে সবচেয়ে বড় গুজব ছিল চিলমারীর বাসন্তী। ১৯৯১ সালে আমরা বাসন্তীর বাড়িতে গিয়েছিলাম। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তখন ছিলেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। এরশাদের পতনের পর নানামুখী ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি। অনেকে ভেবেছিলেন আওয়ামী লীগ শেষ হয়ে যাবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব হবে চ্যালেঞ্জ। ড. কামাল হোসেনরা দলের ভিতরেও অপতৎপরতা শুরু করেছিলেন। তাদের নানামুুখী বক্তব্য-বিবৃতি ছিল দল ও সভানেত্রী বিরোধী। সেই পরিস্থিতি সামাল দিয়ে মাঠে নামেন শেখ হাসিনা। ভোটের পরই তিনি সারা দেশ ঘুরতে শুরু করেন। দলকে করতে থাকেন নতুনভাবে সংগঠিত। তখন এত মিডিয়া ছিল না। টেলিভিশন বলতে একমাত্র বিটিভি। রেডিও বলতে বাংলাদেশ বেতার। জাতীয় দৈনিক হাতে গোনা কয়েকটি। ইত্তেফাক, সংবাদ, বাংলার বাণী, সরকারি পত্রিকা দৈনিক বাংলার বাইরে দৈনিক আজকের কাগজ যাত্রা শুরু করেছিল। পত্রিকাটির মালিক ছিলেন কাজী শাহেদ আহমেদ। সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান। রাজনৈতিক রিপোর্টার হিসেবে আমার বিট ছিল আওয়ামী লীগ। নির্বাচনকালীন থেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সঙ্গে সারা দেশ সফর শুরু হয়। হাতে গোনা দু-চার জন রিপোর্টার শেখ হাসিনার সঙ্গে ঢাকার বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেতেন। আমি তাদের একজন ছিলাম। তখন এত গাড়ির বহর ছিল না। এত নেতা-কর্মীর দাপট ছিল না। নেত্রীর সঙ্গে বেশির ভাগ সময় মাত্র দুটো গাড়ি থাকত। পেছনের গাড়িতে নেত্রীর নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমরা বসতাম। সবাই মিলে একসঙ্গে ঘুরতাম সারা দেশ। টিম সদস্যদের মধ্যে গভীর আন্তরিকতা ছিল।
’৯১ সালের মাঝামাঝি উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাকবলিত এলাকা সফরে যান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। সফরসঙ্গী হিসেবে ছিলাম আমরা চার সাংবাদিক। মৃণালকান্তি দা মিডিয়া দেখতেন। পাশাপাশি তিনি নেত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বও পালন করতেন। মৃণালদা আর নজীব আহমেদের সঙ্গে মিডিয়ার মানুষের সখ্য একটু বেশি ছিল। আগের রাতে আমাদের জানানো হয় ভোর ৬টার ভিতরে তৈরি থাকতে। ফজরের নামাজের পর নাশতা সেরে নেত্রী বেরিয়ে যাবেন কুড়িগ্রাম। আমাদের জন্য চমকপূর্ণ সংবাদ থাকবে। রংপুর সার্কিট হাউসে আমরা ছিলাম। ভোরে সবাই তৈরি হলাম। নাশতা সেরেই কুড়িগ্রামের পথে রওনা হলেন শেখ হাসিনা। পথে কয়েকটি পথসভায়ও বক্তব্য দিলেন। তারপর গাড়ি চলতে থাকে চিলমারীর পথে। চিলমারীর তিস্তাঘেঁষা গ্রামে বাসন্তীর বাড়ি। ১৯৭৪ সালের আলোচিত সেই বাসন্তী। তার জাল পরা ছবি ও খবর প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাকে। সেই খবর আন্তর্জাতিকভাবে সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিব্রত করে। ইত্তেফাকের সেই ছবি বাংলাদেশের গন্ডি পেরিয়ে চলে যায় বিশ্বের অন্য দেশের মিডিয়ায়ও। মার্কিন মেইনস্ট্রিম অনেক মিডিয়া এ ছবি প্রকাশ করে হইচই ফেলে দেয়। সরকার পাল্টা জবাব দিতে পারেনি। তুলে ধরতে পারেনি বিশ্বের কাছে বাংলাদেশে মোটা কাপড়ের দাম জালের চেয়ে অনেক অনেক কম।
গাড়ি থেকে নেমে মাটির সড়কে আমাদের বেশ কিছু দূর হাঁটতে হয়েছিল। হাঁটাহাঁটিতে ক্লান্তি ছিল না আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা পথ দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। আমরা পেছনে পেছনে হাঁটছি। বাসন্তীর ভাঙা বাড়িতে গিয়ে নেত্রী আমাদের ডাকলেন। বললেন, দেখো এই সেই প্রতিবন্ধী বাসন্তী যাকে ’৭৪ সালে জাল পরিয়ে গোয়েবলসীয় প্রচারণা চালানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে। বাসন্তীর বাড়ি তখন যেমন ছিল এখনো তা আছে। বাসন্তীকে নিয়ে সব সরকারই রাজনীতি করেছে। তার ভাগ্যের পরিবর্তনে কেউ কিছু করেনি। তিনি বলেন, জাল পরানোর পুরোটাই ছিল ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রের কঠিন বাস্তবতা তোমাদের দেখাতে, সত্য প্রকাশ করতে নিয়ে এসেছি। শেখ হাসিনা বাসন্তীকে তখন নগদ ৩০ হাজার টাকা দিলেন। বললেন, ক্ষমতায় এলে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা দূর করব। এ অঞ্চলে কোনো অভাব থাকবে না। মানুষের দুঃখ দূর হবে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আনসার সাহেব, যিনি ওই এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন, তিনি বললেন, তখন আশপাশে লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল। নিয়মিত খাবার বিতরণ হতো লঙ্গরখানায়। কোনো সমস্যা ছিল না। হঠাৎ শুনলাম ঢাকা থেকে দুজন সাংবাদিক এসেছেন। তারা বললেন, বন্যার খবর প্রকাশ করতে এসেছি। খবর দেখে আরও সাহায্য বাড়াবে সরকার। তারাই বাসন্তীর শরীরে জাল পরালেন টাকা দিয়ে। ছবি তোলার সময় পাট খেতে শাক তুলছিল বাসন্তী। প্রতিবন্ধী গরিব ঘরের মেয়েটি কথাও বলতে পারত না। অথচ তাকে ব্যবহার করা হলো সরকারবিরোধী হাতিয়ার হিসেবে। উত্তরাঞ্চলের বিখ্যাত সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন রংপুর থেকে এসেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর খবর সংগ্রহ করতে। তিনি বললেন, বাসন্তী প্রতিবন্ধী তিনি অনেক আগেই দৈনিক সংবাদে এ খবর প্রকাশ করেছেন। বাসন্তীকে নিয়ে শেখ হাসিনা তাঁর কথা রেখেছেন। তিনি ’৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বাসন্তীর জন্য আবার টাকাপয়সা পাঠিয়েছিলেন। তার ঘর মেরামত করে দিয়েছিলেন। ২০০৯ সালেও তিনি বাসন্তীকে ভোলেননি। তাকে বাড়ি তৈরি করে দিয়েছেন। বাসন্তী মারা গেছেন। তবে এখনো বাসন্তীকে নিয়ে আলোচনা হয়। বাসন্তীকান্ড নিয়ে মৃত মানুষকে নিয়ে কথা বলতে চাই না। আল্লাহ সবাইকে ক্ষমা করুন। সেই ঘটনার রিপোর্টার ইত্তেফাকের শফিকুল কবীরের শেষ জীবন ছিল বড় বেদনার। তার পুত্রের দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনায় পুত্রবধূ ও দুই নাতি-নাতনি আত্মহত্যা করেন। তারা মৃত্যুর আগে সংকট নিরসনে তাদের পাশে না থাকার জন্য শফিকুল কবীরকে দায়ী করেন। আত্মহত্যার আগে দেয়ালে অনেক কথা লেখা ছিল। অন্যদিকে ফটোসাংবাদিক আফতাব আহমেদও নিঃসঙ্গ জীবনে খুনের শিকার হন। তার টাকাপয়সা লুট করতেই দারোয়ান-ড্রাইভার তাকে খুন করে। পরে পুলিশ খুনিদের আটক করে ঘটনার রহস্য উন্মোচন করে।
স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি কুৎসা রটনাতে ছিল জাসদের মুখপত্র গণকণ্ঠ। শেখ কামালের বিরুদ্ধে কল্পিত ব্যাংক ডাকাতির মিথ্যাচার গণকণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছিল। সেদিন শেখ কামালের সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন আজকের বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, শমসের মবিন চৌধুরীর ভাই শাহান, উত্তরা ক্লাবের সদস্য ও ব্যক্তিগত জীবনে ব্যবসায়ী মাসুদ ভাইসহ আরও অনেকে। তারা সবাই শেখ কামালের সঙ্গে চলতেন। ঘটনার নীরব সাক্ষী ছিলেন তারাও। তাদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। সবাই মিলে ঘুরতে বের হয়ে খবর পান বাংলাদেশ ব্যাংকে সর্বহারা পার্টির অস্ত্রধারীরা ও জাসদের গণবাহিনী হামলা করেছে। এ খবরের সত্যতা জানতে গিয়ে নটর ডেম কলেজের সামনে পুলিশের ভুল বোঝাবুঝির শিকার হন শেখ কামালসহ তাঁর বন্ধুরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে তারা যাননি। তার আগেই পুলিশ তাদের গাড়িকে গণবাহিনীর গাড়ি মনে করে গুলি করেছিল। এ খবরটিকে ভয়াবহভাবে মিথ্যা রূপ দিয়ে খবর প্রকাশ হয়েছিল জাসদের গণকণ্ঠে। জাসদের তৈরি করা সেই কুৎসার জবাব এখনো আওয়ামী লীগকে দিতে হয়। তখন গণকণ্ঠ, হক কথাসহ অনেক পত্রিকার কাজ ছিল সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারকে বিব্রত করা। এগুলো মোটেও সাংবাদিকতা ছিল না। গোয়েবলসীয় কায়দায় প্রকাশিত মিথ্যাচার সাংবাদিকতা হতে পারে না।
যুগে যুগে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রকাশিত হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। আওয়ামী লীগ কোনো কিছুর জবাব সঠিকভাবে দিতে পারেনি। এখনো পারছে না। আর পারছে না বলেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। পরিকল্পিতভাবে মিথ্যাচার হচ্ছে দেশ-বিদেশে। সাইবার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতের মতো উদার গণতান্ত্রিক দেশও কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ইউটিউব, ফেসবুকের কনটেন্ট কঠোরভাবে নজরদারিতে রেখেছে ভারত। এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা বাধ্য করেছে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে অফিস খুলতে। ভারত পারলে আমরা কেন পারছি না জানি না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও রাষ্ট্রনায়কদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের একটা সীমারেখা থাকে। পশ্চিমা দেশ মুখে অনেক কথা বলে। সামাজিক মাধ্যমের দিকে তাদের রাষ্ট্রনায়কদেরও কঠোর দৃষ্টি রয়েছে। বাংলাদেশকে এ নিয়ে বসে থাকলে হবে না। একটা অবস্থান অবশ্যই নিতে হবে। রাষ্ট্র, জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো নোংরা কুৎসামূলক ভিডিও তুলে নিতে হবে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মাননীয়রা কী কাজ করছেন জানি না। সরকারকে সাইবারসন্ত্রাস নিয়ে অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে।
মিডিয়ার গুজব সবচেয়ে বেশি হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। হিটলারের তথ্যমন্ত্রী ছিলেন গোয়েবলস। তিনি জিন্দাকে মুর্দা আর মুর্দাকে জিন্দা বানাতেন। তখন রেডিও ছিল সবচেয়ে বড় মাধ্যম। যুদ্ধ সামনে রেখে জার্মানির ঘরে ঘরে রেডিও পৌঁছে দেন হিটলার। রেডিওতে প্রতিদিন যুদ্ধ নিয়ে কেচ্ছাকাহিনি তৈরি করতেন গোয়েবলস। মানুষ রেডিওর খবর অন্ধভাবে বিশ্বাস করত। মানুষের সেই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়েছিলেন গোয়েবলস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোথাও জার্মানির সেনারা পরাজিত হলে হিটলারের মিডিয়ায় প্রচারিত হতো বিশাল জয়ের খবর। তখন এত যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ ছিল না। গোয়েবলস তার প্রথম জীবন থেকে এমন ছিলেন। শুধু বেতার নয়, পত্রপত্রিকায়ও দীর্ঘ সময় জুড়ে মিথ্যাচারে লিপ্ত ছিলেন গোয়েবলস। আর মিথ্যাচারের পুরস্কারও পেতেন হিটলারের কাছ থেকে। গোয়েবলসের মূল থিওরি ছিল একটি মিথ্যাকে বারবার প্রকাশ করা। মানুষ একটা সময় তা সত্য বলে ধরে নেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে হিটলার ও গোয়েবলস যুগের অবসান হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিকভাবে তার অনুসারীর সংখ্যা কমেনি। এখনো এই যুগে এই সময়ে এমন মিথ্যাচারই হয়। মানুষ মিথ্যাচার মন দিয়ে পড়ে, শোনে ও দেখে। কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না। তার পরও প্রচারকারীরা থামে না।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন