ঢোঙ্গা ব্যবসায়ী থেকে গাজীপুরের নগরপিতা হওয়া জাহাঙ্গীর আলমের উত্থান রীতিমত নাটকীয়। গাজীপুর মহানগরের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কানাইয়া গ্রামে কৃষক মিজানুর রহমানের ঘরে ১৯৭৯ সালে জাহাঙ্গীরের জন্ম। ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে পড়াকালীন সময়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ছাত্রলীগের প্রভাব খাটিয়ে ঢোঙ্গা ব্যবসার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়।
বিএনপি জামাত সংশ্লিষ্টতা:
জাহাঙ্গীরের পরিবার মূলত জামাত ঘরানার। দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ খ্যাত গাজীপুরে আওয়ামী লীগের সমর্থন সবসময়ই বেশি ছিল। ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় জাহাঙ্গীর। কিন্তু
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দুর্দিন শুরু হলেও তৎকালীন বিএনপি নেতা হাসান সরকারের আশির্বাদপুষ্ট হয়ে ওঠেন জাহাঙ্গীর। বিএনপি জামাতের ক্যাডারদের নিয়ে গড়ে তোলেন ঝুট ব্যবসার সিন্ডিকেট এবং বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যান। এ সময় জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা সহ বেশ কয়েকটি মামলা হলেও অদৃশ্য ইশারায় সব মামলা থেকে খালাস পান।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জাহাঙ্গীর:
২০০৯ সালে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন জাহাঙ্গীর।
এরই জেরে চলে আসে অগাধ রাজনৈতিক ক্ষমতা। ঝুট ব্যবসার একক নিয়ন্ত্রক হয়ে যান। আওয়ামী লীগের নেতা হলেও বিএনপি-জামাতের নেতাকর্মীদের প্রধান পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। ২০১৪ সালে মেয়র নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে বঞ্চিত হয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আজমত উল্লাহ খানকে পরাজিত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ২০১৮ সালে মনোনয়ন পেয়ে মেয়র পদে বিজয়ীহন।
অবৈধ অর্থ সম্পদের পাহাড়:
শিল্পনগরী গাজীপুরের বিভিন্ন মিল কারখানায় নামে-বেনামে শুরু করেন ঝুট ব্যবসা। আধিপত্য বিস্তারের জন্য তৈরি করেন নিজস্ব বাহিনী। অল্প সময়ের ব্যবধানে জাহাঙ্গীর শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। বিঘার পর বিঘা জমি কেনেন উচ্চ মূল্যে। জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, তার টাকার পরিমাণ তিনি নিজেও জানেন না। হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বহু আগেই।
আইনের তোয়াক্কা না করেই তিনি কোনোরকম টেন্ডার ছাড়াই মহানগরে শত শত কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণ করেছেন, যাতে দুর্নীতির গন্ধ পাচ্ছেন অনেকে। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য স্থানীয়দের হাজার হাজার বিঘা জমি নষ্ট করলেও সঠিক ক্ষতিপূরণ দেননি তিনি।
বিএনপি জামাত নিয়ে রাজনীতি:
বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের লোকজন নিয়ে তিনি দাতব্য সংস্থা 'জাহাঙ্গীর আলম ফাউন্ডেশন' গড়ে তুলেছেন। আওয়ামী লীগের ব্যানারে সব কিছু করলেও দলীয় সব নেতাকর্মী সেখানে উপেক্ষিত। ওই সংগঠনে যুক্ত লোকজনের সঙ্গেই তার উঠাবসা ছিল। মহানগরের ৫৭টি ওয়ার্ডেই এ সংস্থার কমিটি রয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার সমর্থকরা 'জাহাঙ্গীর, জাহাঙ্গীর' বলে স্লোগান দিতেন। সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামও নেওয়া হতো না।
মেয়র হওয়ার পরে নিজ উদ্যোগে বিএনপি জামাত ও হেফাজত সমর্থক ৩০০ জনকে ট্রাফিক সহকারী হিসেবে নিয়োগ দান করেন মহানগরে। খর্ব করেন ট্রাফিক পুলিশের পেশাদারি কর্তৃত্ব। সিটি এলাকার সড়ক-মহাসড়কগুলোর নিয়ন্ত্রণ এভাবে প্রায় পুরোটাই কবজা করে ফেলেন তিনি।
জামাত নেতাদের সহযোগিতায় যানজট নিরসনের দোহাই দিয়ে নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য সিটিজুড়ে চক্রাকার বাস সার্ভিস 'তাকওয়া পরিবহন' চালু করেন। প্রশিক্ষিত ট্রাফিক পুলিশের বদলে তার ট্রাফিক সহকারীরা গোটা মহানগরীর সড়ক-শৃঙ্খলার বারোটা বাজায়। ভয়ে এ বাহিনীর অনাচারের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার সাহসও পাননি কোনো নগরবাসী।
হেফাজত তোষণ:
বিএনপি জামাত ছাড়াও হেফাজতে ইসলামের বড় পৃষ্ঠপোষকদের একজন জাহাঙ্গীর। সাবেক শিবির নেতা আব্দুর রহিম মাদানী জাহাঙ্গীরের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন। রহিম তার গাজীপুরের মাদ্রাসার ছাত্রদের উগ্র জঙ্গিবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া গাজীপুরের সকল ওয়াজ মাহফিলে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী সহ জামাত নেতাদের মুক্তি চেয়ে সরকার বিরোধী বক্তব্য দেওয়া হয়। এগুলো জাহাঙ্গীরের সমর্থন ছাড়া সম্ভব নয়। এছাড়া হেফাজতের সকল মিছিল সমাবেশ, এমন কি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বিরোধী সমাবেশ আয়োজনেও জাহাঙ্গীর আর্থিক সহায়তা সহ সার্বিক সুযোগ সুবিধা প্রদান করেছে। এমন কি হেফাজতের মিছিলে বিরুদ্ধে কর্মসূচি দেওয়ায় আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সমালোচনাও সে করেছে।
নগরপিতার উল্টোপথে যাত্রা:
জনপ্রতিনিধি হয়েই তিনি উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করেন। গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী, আইনের তোয়াক্কা না করেই তিনি কোনোরকম টেন্ডার ছাড়াই মহানগরে শত শত কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণ করেছেন, যাতে দুর্নীতির গন্ধ পাচ্ছেন অনেকে। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য স্থানীয়দের হাজার হাজার বিঘা জমি নষ্ট করলেও সঠিক ক্ষতিপূরণ দেননি তিনি। অনেকের অভিযোগ, তিনি গাজীপুর সিটির 'একচ্ছত্র অধিপতি' হতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
গাজীপুরের অবস্থা ভয়াবহ:
গাজীপুর সিটি করপোরেশনে নিবন্ধিত হোল্ডিংয়ের সংখ্যা ১ লাখ ২৯ হাজার ৫৬৪টি। এর মধ্যে মাত্র ১১ হাজার ৮৯৫টি বাড়িতে পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশনের সংযোগ রয়েছে। পানির পাইপলাইন রয়েছে ১১৯ কিলোমিটার। এক দশকেরও বেশি সময় আগে দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন হিসেবে যাত্রা করেছিল গাজীপুর। শিল্প শহর হিসেবে পরিচিত এই শহরের আয়তন ৩২৯ দশমিক ৫৩ বর্গকিলোমিটার।
সিটি করপোরেশন থেকে এই হিসাব দিলেও বাস্তব পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ বলে দাবি স্থানীয়দের। তাঁরা বলছেন, এই ১০ বছরে তাঁদের ট্যাক্স বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু নাগরিক সুবিধা বাড়েনি মোটেও। গাজীপুর পৌরসভার ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. তাইজুদ্দিন একজন নুড়িপাথর ব্যবসায়ী। তাঁর দাবি, পৌরসভার অধীনে থাকতে তাঁকে বসতবাড়ি ও আশপাশের জমির ট্যাক্স বাবদ সব মিলিয়ে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা পরিশোধ করতে হতো।
নাগরিক সুবিধার মধ্যে গ্যাস সংযোগ ও বিদ্যুৎ সুবিধা তাঁর বাড়িতে পৌরসভার সময় থেকেই ছিল। পানির সংযোগ এখনও পর্যন্ত তাঁর বাড়িতে আসেনি। তাঁর জমির পরিমাণ বাড়েনি এক ইঞ্চিও। তবে এখন তাঁকে সব মিলিয়ে ৭ হাজার টাকার বেশি ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে ঢোকার এত জ্বালা, আগে বুঝতে পারিনি।’
অন্যায় অবিচার:
টেন্ডার দেওয়া ছাড়াই মেয়র জাহাঙ্গীর মহানগরে ৮০০ কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণ করেছেন। এতে প্রয়োজন হয়েছে নাগরিকদের প্রায় ৮ হাজার বিঘা জমি। প্রায় ৩১ হাজার ঘরবাড়ি, মসজিদ-মন্দির, কবরস্থান সরিয়ে তিনি এই রাস্তা করেছেন। তবে নগরবাসীর অভিযোগ, রাস্তা নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ না করে তিনি তার ইচ্ছামতো এসব করেছেন। ক্ষতিপূরণ হিসেবে মর্জিমাফিক টাকা দিয়েছেন। অনেকে সে টাকাও পায়নি। তাদের অভিযোগ, ক্ষমতার দাপটে মেয়র তাদের ওপর অত্যাচার করেছেন।
জাহাঙ্গীর মেয়র হয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে আওয়ামী লীগের। ত্যাগী ও পরীক্ষিত সকল নেতাকর্মীদের নির্বাসনে বা নিষ্ক্রিয় করে পা'চাটা বাহিনীকে ঘিরে তার কর্মকাণ্ড চলে।
স্থানীয়রা জানান, নাটকীয় উত্থান হলে আকস্মিক পতনের আশঙ্কা থাকে। মেয়র জাহাঙ্গীরের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। তার কারণে বহু মানুষ নিজের জমি হারিয়ে কেঁদেছেন। দলের নেতাকর্মীদের দীর্ঘ
শ্বাস ও সাধারণ জনগণের অভিশাপ গ্রাস করেছে তাকে।