শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা এবং আর্থিক ব্যবস্থায় অনগ্রসর দেশে ততটা বাকস্বাধীনতা আশা করা অন্যায়। এই অবারিত স্বাধীনতা অনগ্রসর দেশে দেওয়া হলে তা হবে শিশুর হাতে খুন্তি তুলে দেওয়ার শামিল।
এতেই কিন্তু স্পষ্ট হয় যে, বিএনপি আদতে বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায়, তা তাদের আসল চাওয়া নয়। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পা রেখেছে। লক্ষ্য এখন ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানো। তবে সে পথটা এখনো অনেক লম্বা। এখন আমাদের যে অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষিতের হার, অর্থনৈতিক অগ্রগতির যে অবস্থা, নাগরিকদের সচেতনতাবোধ ও সভ্য আচরণ শিক্ষণের যে অবস্থান, রাষ্ট্রের সামগ্রিক অবস্থার যে মানদন্ড, তার ওপর ভিত্তি করেই বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেওয়ার কথা। তা না হলে যা বলেছেন লাস্কি; তা হবে— শিশুর হাতে লোহার খুন্তি তুলে দেওয়ার মতো। এর দায়ভারও সম্পূর্ণভাবে বর্তায় বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর, তাদের অপরাজনীতি ও দেশ নিয়ে চক্রান্ত যে বন্ধ হচ্ছে না।
বিএনপি-জামায়াত ও সরকারবিরোধী অশক্তিগুলোর অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে গুজবসেল। লন্ডনে পলাতক বিএনপি নেতা তারেক রহমানের নির্দেশে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসী ফেসবুকার ও ইউটিউবারদের দিয়ে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিনিয়ত গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের সাথে যুক্ত রয়েছে দেশি-বিদেশি কিছু সংবাদমাধ্যমও। সম্মিলিত এই গোষ্ঠী কোনো গুজব বাজারে ছড়িয়ে দিয়ে তার সপক্ষে পত্রিকায় প্রতিবেদনের চেহারায় ভাড়াটেদের দিয়ে কলাম লেখানো হয়।
পত্রিকায় প্রকাশিত কলামগুলো হয় মূলত ব্যক্তির মতামত, যার সাথে সংবাদপত্রের সম্পাদক ও প্রতিবেদকদের কোনো দায় থাকে না, যা কলামের নিচেই উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ, এই ভাড়াটেদের পরিবেশিত গুজব ও প্রোপাগান্ডাগুলো এসব সংবাদপত্রে বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংবাদ প্রতিবেদনের ছদ্মাবরণে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। অসচেতন নাগরিকরা এসব ব্যক্তিগত মতামত তথা প্রোপাগান্ডাগুলোকে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ভেবে বিভ্রান্ত হয় এবং দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিতে পরোক্ষ সহায়তা করে।
এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে গুজবসেল তাদের কাজ করে যাচ্ছে। এমন অনেক বিভ্রান্তিকর লেখার কারণে বেশ কয়েকমাস আগে ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় সৃষ্টির একটা প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এই দেশবিরোধী চক্রটি। প্যানিকড হয়ে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে শুরু করে। সরকারের ত্বরিৎ পদক্ষেপে জনগণকে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরার পর পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হয়। এর আগে করোনাকালেও টিকাসহ প্রাণরক্ষাকারী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গুজব ও প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল চক্রটি। তবে শেষ পর্যন্ত সরকারি সংস্থাগুলোর পদক্ষেপে বাংলাদেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায়।
এর আগে পদ্মা সেতু নিয়ে গুজব মিথ্যাচারে নেতৃত্ব দিয়েছিল চিহ্নিত কয়েকটি গণমাধ্যম, যা সবাই এখন জানেন। কই, সেসব গণমাধ্যম তো বন্ধ করে দেয়া হয়নি! তাহলে বাকস্বাধীনতা হরণ হচ্ছে কীভাবে? সংবাদমাধ্যমের ওপর কি সেন্সরশিপ আরোপ বা গলাটিপে ধরা হয়েছে? তা তো নয়। গুজব বা মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশের কারণে কোনো অনুমোদিত পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল বন্ধ করা হয়নি। বরং সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতায় নতুন নতুন সংবাদপত্র চালু হচ্ছে দেশে, টিভি চ্যানেল বাড়ছে, তরুণ সমাজ সাংবাদিকতাকে একটি দায়িত্বশীল ও আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারছে। অথচ বিএনপি-জামায়াত আমলে সাংবাদিকদের গাছের সাথে উল্টো করে বেঁধে ঝুলিয়ে কিংবা বোমা মেরে, গুলি করে হত্যার শত শত নজির রয়েছে।
বর্তমানে দেশে কোনো রাজনৈতিক নেতার যে কোনো বক্তব্য প্রচারিত হয় সংবাদমাধ্যমে। সে নেতা মিথ্যা বলুক বা গুজব ছড়াক, তা ছাপানো হয় এবং দেখানো হয় গণমাধ্যমে। বরং গণমাধ্যমের সবচেয়ে বেশি অপপ্রচারের শিকার হয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে। যার সর্বশেষ উদাহরণ, আমিষের আরেকটি উৎস হিসেবে কাঁঠালের পুষ্টিগুণ বিষয়ে তাঁর একটি বক্তব্যকে মিসলিডিং আকারে পরিবেশন করেছে দেশের প্রথম সারির সংবাদপত্রগুলোতে।
সেখানে দাবি করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নাকি গোমাংস না খেয়ে তার পরিবর্তে কাঁঠাল খেতে নির্দেশ দিয়েছেন দেশবাসীকে! অথচ প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে কাঁঠালেও পর্যাপ্ত আমিষ থাকার কথা বলেছেন, বাংলাদেশে যে বিপুল কাঁঠাল উৎপাদন হয়, সেটা বিদেশে রপ্তানির উৎসাহ দিয়েছেন, পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে কাঁঠালের ব্যাপক চাহিদা ও এ দিয়ে যেসব খাদ্য প্রচলিত রয়েছে, সেসম্পর্কে বলেছেন, যেন দেশের মানুষ কাঁঠালকে অবহেলা না করে একে অর্থকরী ফসল হিসেবে দেখে। কিন্তু তাঁর বক্তব্যকে যারা বিকৃত করেছে, ঠাট্টার শিকার বানিয়েছে, সেসব পত্রিকা বা প্রতিবেদকদের বিরুদ্ধে কি সংবাদপত্রের নীতিমালার আওতায় কোনো বিচার হয়েছে? হয়নি। তাহলে বাকস্বাধীনতা হরণ হচ্ছে ঠিক কোথায়?
গুজব প্রচারে বাধা দিলেই কি বাকস্বাধীনতা নেই দাবি করা যাবে? শিশুদের হাতে ১০ টাকা তুলে দিয়ে তার ছবির সাথে ভুয়া বিবৃতি ছেপে চাইল্ড এক্সপ্লয়টেশন করা হলে, সেটা প্রতিহত করা যাবে না? আজ চিৎকার করে রাজনৈতিক দলগুলো এবং অনেক প্রবীণ সাংবাদিক বাকস্বাধীনতা কোথায়- প্রশ্ন করেন যখন, সেই সাংবাদিকরা দায়িত্বে থাকা অবস্থাতেই যখন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, যখন ২১শে আগস্টে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে উল্টো হতাহতদের ওপর দায় চাপানো হয়েছিল, যখন সার ও বিদ্যুতের জন্য কৃষক-জনতাকে গুলি করে হত্যা করে সেসব খবর চেপে যাবার জন্য চাপ দেয়া হয়েছিল, তখন এই বাকস্বাধীনতা বা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার দাবি কোথায় ছিল? তখন তো এই সাংবাদিকরাই মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। এখন বাকস্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেন তারা।
ক’দিন আগেই সরকারি গাড়ি পোড়ানো ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের একটি পুরনো মামলায় অল্প কিছুদিন জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে এসেই বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গণমাধ্যমের সামনে দাঁড়িয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার মাধ্যমে এটি আবারও প্রমাণিত হয়েছে যে, দেশে বাকস্বাধীনতা নিশ্চিতভাবেই আছে। রিজভী বলেছিলেন, ‘ছোট কারাগার থেকে বড় কারাগারে এসেছি।’ এখন কেউ যদি জনাব রিজভীকে গিয়ে বলেন, তাহলে আবার ছোট কারাগারে ফিরে যান, যেহেতু ওটা আপনার জন্য তুলনামূলক আরামদায়ক ছিল, তাহলে কি তিনি সেখানে ফিরে যাবেন?
বাংলাদেশে যেভাবে বিরোধীদলগুলো সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা এমন কি মাঝেমধ্যে গভীর রাতেও সরকারের প্রতি বিষোদগার করছে এবং যেভাবে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে, তার নজির পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, যাকে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ আখ্যা দেয়া হয়, সেখানেও নাই। একটি বক্তব্যের কারণে ভারতে বিরোধীদলের বড় নেতা রাহুল গান্ধীর ২ বছরের জেল হয়েছে, সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়েছে। তার বিরুদ্ধে যিনি মামলা করেছেন তিনি ক্ষমতাসীন দল বিজেপির একজন নেতা এবং সাংসদ।
বাংলাদেশে বিরোধীদলের নেতারা যেভাবে বক্তব্য রাখেন এবং প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারি দলের ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে যেভাবে বক্তব্য রাখেন, সেজন্য ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতা মামলা করেছেন কি না, খোঁজ নিয়ে দেখুক বিএনপি। এ থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চা ও বাকস্বাধীনতা কতটা সুসংহত। এখানে গণতান্ত্রিক চর্চা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অনেক দেশের চেয়েও ভালো, উন্নত। এমন কি ভারতের চেয়েও বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বেশি।
২০০৮ সালের ১২ই ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনি ইশতেহারে ‘দিন বদলের সনদ’ ঘোষণা করেছিলেন বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই ইশতেহারে বলা হয়, ২০২১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে। এ নিয়ে সেসময় থেকে পরবর্তী অনেক বছর বিএনপি ও দেশবিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠ হাসি-ঠাট্টা ও ট্রল করেছিল। দেশ কিন্তু ডিজিটাল হয়ে গেছে ২০২১ সালের আগেই। এমনকি বর্তমানে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। নতুন করে শুরু হয়েছে বিরোধীদের মশকরা।
অথচ দেশে উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা, অবারিত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন পৌঁছে যাওয়া, সেন্সরমুক্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রচার ব্যবস্থার সকল সুযোগ-সুবিধার পুরোটাই ভোগ করছে দেশ ও স্বাধীনতাবিরোধীরা। তারা এসব ডিজিটাল সুবিধা প্রয়োগ করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে হুমকিতে ফেলতে ছড়িয়ে দিচ্ছে গুজব ও মিথ্যাচার। প্রোপাগান্ডায় উস্কানি দিয়ে রাস্তায় তাণ্ডব সৃষ্টি করা, মানুষ হত্যা করা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা- সবকিছুই করছে তারা বর্তমান সরকারের গড়ে দেয়া ডিজিটাল সুবিধাগুলো ব্যবহার করে। এরপরেও তারা মাইকের সামনে গলাবাজি করে- দেশে বাকস্বাধীনতা নাই, গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না… ইত্যাদি।
অর্ধশতাধিক বেসরকারি টেলিভিশন, এফএম রেডিও, কমিউনিটি রেডিও এবং সহস্রাধিক সংবাদপত্রের নিবন্ধন দিয়ে সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্প্রসারিত করেছে। সেই সঙ্গে ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাক, ব্যক্তি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে। বরং এই সুযোগের অপব্যবহার করে মির্জা ফখরুলসহ বিএনপি নেতারা প্রতিনিয়ত চিরায়ত ভঙ্গিতে সরকারের বিরুদ্ধে নিলর্জ্জভাবে মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। শুধু বাকস্বাধীনতা ভোগ করাই নয়, নিজেদের ইচ্ছা মতো মনগড়া অপপ্রচার চালাতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করে না।